সিনেমা দেখতে যাবার কোনোই ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু গরম পপকর্ণ আর ঠাণ্ডা বিয়ারের লোভও সামলানো যাচ্ছিল না। হলে গিয়ে দেখি জেসন মোমোয়ার ছবি চলে। নাম—দ্য আকুয়াম্যান।

আমি তো এই ছবি না দেখে কিছুতেই ঘরে ফিরবো না! আর আমার সঙ্গের যিনি তার না পছন্দ হয় মাসলওয়ালা ছেলে আর না পছন্দ হয় এইসব সুপারহিরো টাইপের সিনেমা। তাই উনি আমার পায়ে ধরা বাকি রাখলেন ওই হলে না ঢোকার জন্য।
আমি কারো কথায় ঢেঁকি গেলার লোকই না। জেসন মোমোয়া আছে বলে কথা। তার উপর আকুয়াম্যান মানে সে পানিতে ভিজে টিজে ছোট ছোট কাপড় পরে সাগর থেকে উঠবে নিশ্চয়ই! পোস্টারেও ওরকমই দেখা যায়।
আমি দৌড়ে চলে গেলাম হলের ভেতর। এক পাশে বেকস, এক পাশ পপকর্ণ, মাঝখানে আমি আধাশোয়া। সিনেমা শুরু হইল।
পানি থেকে উঠে আসল নিকোল কিডম্যান। সে দুনিয়াতে এসে বিয়ে করল। তারপরে তার সুখের সংসার হইল। ছেলে হইল। কিন্তু একদিন তার বাপের বাড়ি পানির লোকেরা এসে তাকে আক্রমণ করল আর তার ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজে তাদের কাছে ধরা দিল। ছেলেকে রেখে চলে গেল পানির রাজ্যে।
এতটুকু নাহয় সহ্য করা গেছে। জেসন মোমোয়া এখনও বড় হয় নাই। হইলে নিশ্চয়ই মারদাঙ্গা কিছু হবে!
কিছুই হইল না। বড় জেসন মোমোয়া মানে আকুয়াম্যান একটা গাধা আর সারাক্ষণ খালি অন্যের মাইর খায় আর কান্দে।
এসব ফালতু জিনিস আর কাহাতক সহ্য হয়! বাস্তব দুনিয়ায় যারা কথায় কথায় কান্দে আর অন্যের কাছে মাইর খায় এদেরকে আমি একদমই পছন্দ করি না।
আমার জন্ম ২৫ শে ডিসেম্বর, যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিনে। আর এইজন্যই আমি তার উল্টা চরিত্র। মানে কেউ যদি আমার এক গালে আঁচড়ও দেয় আমি তাকে পাঁচটা থাপ্পড় তো দিবোই সাথে হাতটাও ভেঙে দিব। আমার মত একটা মারকুটে লোকের পক্ষে এইসব ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান কতক্ষণ সহ্য করা সম্ভব! তার উপর আমার ফেভারিট নায়ক সে। দেখতে সুন্দর। সেইরকম চুল, সেই চেহারা, কাটা কাটা ভ্রু আর উফ মার্কা বডি! আমার কেন সহ্য হবে তার এই বোরকা পরা নাঁকি কান্নাওয়ালা সিনেমা?
পপকর্নও শেষের পথে এদিকে জেসন মোমোয়া আকুয়াম্যান তার গার্লফ্রেন্ডকে বলল, আমি এসব সংঘাতে যাব টাব না। আই অ্যাম অ্যান অর্ডিনারি ম্যান।
এটা ছিল আমার ধৈর্য্যের কফিনে শেষ পেরেক।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। পাশের ব্যক্তিকে বললাম, ভাই আমি খুব খুব খুব সরি। আপনাকে এতক্ষণ ধরে অত্যাচার করলাম। আমারে মাফ করে দিয়েন। চলেন যাই গা। আমার আর লাগবে না এই সিনেমা দেখা।
উনি কেঁউ কেঁউ স্বরে বললেন, কেন? কেন? দেখেন!
আমি বললাম, না ভাই। আমি অর্ডিনারি ম্যানের জন্য সময় নষ্ট করতে রাজি না। আই অ্যাম নট অর্ডিনারি। যে নিজেই নিজেরে তুচ্ছ ভাবে তারে আর লোকে কী ভাববে! এসব কান্নাকাটি ভ্যাঁভ্যাঁ আমার ভালো লাগে না। চিপ লাগে। চলেন ভাই আর সময় নষ্ট না করে যাইগা।
আমি দাঁড়ায়ে গেলাম। আর হলের লাইট সব জ্বলে উঠলো। বিরতির সময় এখন। আমি ঘুরে দেখলাম পাশের লোকের চোখে পানি। সে এতক্ষণ বসে বসে কাঁদতেছিল। অন্ধকার দেখা যায় নাই।
আমি হতভম্ব। কাঁদার মত কী বললাম! এমন কিইবা করলাম! একজন পূর্ণবয়স্ক লোক চোখের চশমা খুলে চোখের পানি মুছতেছে এমন দৃশ্য দেখে আমি তো মহাবিব্রত।
আপনি কাঁদছেন কেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
উনি বলল, এই যে নিকোল কিডম্যানের এত সুখের সংসার ছিল প্যাট্রিক উইলসনের সাথে। লোকগুলো এসে ওকে কোথায় নিয়ে গেল! কী কষ্ট প্যাট্রিকের! আহারে কত বছর তাকে অপেক্ষা করতে হবে কে জানে! আপনি যদি কিছু মনে না করেন আমি কি সিনেমাটা শেষ করে যেতে পারি? নিকোল কি বেঁচে আছে নাকি ওকে মেরে ফেলছে, ও কি প্যাট্রিকের কাছে ফিরতে পারবে কিনা এটা না জানলে আমার খুব খারাপ লাগবে। আপনাকে আমি আরেকটা পপ কর্ন এনে দেই?
নিকোল কিডম্যান বেঁচে ছিল। পরে সে প্যাট্রিকের কাছে ফিরেও আসছিলো। কিভাবে সেটা ভালোমত দেখার সুযোগ আমার হয় নাই। আমি পাশের ব্যক্তিকে টিস্যু সরবরাহ করতে ব্যস্ত ছিলাম।
সে চোখের পলক না ফেলে সিনেমা দেখে আর কিছুক্ষণ পরপর চশমার কাঁচের ফাঁকে টিস্যু ঢুকায়ে চোখের পানি মোছে। আবার ফ্যাঁচফ্যাঁচ শব্দ করে নাকের পানি মোছে। তার পাশে যে একটা মহাজ্ঞানী মেয়ে বসে আছে যে কিনা তাকে একটু আগেই কান্নাকাটি কত চিপ ব্যাপার বলে ফলিত গভীর জ্ঞান দেবার চেষ্টা করেছে, সেই মেয়েটা যে তার দিকে এখন হাঁ করে তাকায়ে আছে এ বিষয়ে তার কোনো মনোযোগই নাই।
সিনেমা শেষ। নায়ক নায়িকার চোদ্দগুষ্টিসহ মিল হয়ে গেছে। কান্নাকাটি শেষ। এবার দর্শকটি খুব খুশি। আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে বলল, চলেন যাই। আপনাকে পৌঁছে দেই।
আমি বললাম, আমি একটু ওয়াশরুমে যাব। আপনি দাঁড়ান।
বলে দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে রাইসুকে ফোন করলাম। বললাম,
রাইসু, সর্বনাশ হয়ে গেছে!
রাইসু বলল, কী সেটা?
আমি বললাম, আমার তো প্রেম হয়ে গেছে!
রাইসু বলল, কার সাথে? নাম কী?
আমি বললাম, চিনবে না তুমি। পরিচিত না তো। অর্ডিনারি ম্যান।
রাইসু বলল, অর্ডিনারি ম্যানের সাথে আবার তোমার কিসের প্রেম?
আমি বললাম, সিরিয়াস প্রেম। সে খালি কান্দে। আমার তো মনে হচ্ছে এই লোককেই আমি বিয়ে করব।
রাইসু হাসতে হাসতে শেষ। আমি কানতে কানতে শেষ। এমনও লোক হয় যে একটা ফালতু বস্তাপচা সিনেমা দেখে কানতে কানতে আধামরা হয়ে যায় আর আশেপাশে কে কী ভাবল তার তোয়াক্কাই করে না!
সেই লোককে নিয়ে আজ পর্যন্ত আর কোনো দুঃখের সিনেমা দেখি নাই আমি। নায়ক নায়িকার চোদ্দগুষ্টির মহামিলন আছে যে সিনেমায়, আইএমডিবিতে আগে থেকে জেনে নিয়ে সে সিনেমাগুলিই তার সাথে একসাথে দেখি। তারপরও একটু ফাঁকফোকর পেলেই সিনেমা দেখে তার মহা মন খারাপ হয়ে যায়।
অথচ দুঃখের সিনেমা দেখি আমি একা একা। একা দেখলেও মানুষের সামনে কাঁদতে আমি আর ভয় পাই না। আগে ভাবতাম অন্যদের সামনে কাঁদা বা কোনো ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ করলে আমি ছোট হয়ে যাব। কোনো ধরনের দুঃখ কষ্টের কথা শেয়ার করলে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিবে হয়ত কেউ।
এখন আর তেমন মনে হয় না। ব্যক্তিগত মহাবিপর্যয়ও বন্ধুদের ফোন করে বা ডেকে ডেকে বলি। নিজেকে অনেক শক্তিশালী মনে হয়। মনে হয় আমার দুর্বলতাগুলো আসলে আমার শক্তি। এগুলি লুকানোর কিছু নাই। আমি যেমন তেমনই। সেটা সোসাইটির প্রত্যাশিত ইমেজ হোক আর হোক তার বিপরীত। নিজেকে নিয়ে কোনো দ্বিধা করি না। সবার আগে নিজেকেই সাপোর্ট করি।
আজকে জেমস ক্যামেরনের এই ফালতু কোট ফেসবুকে দেখে এ লেখাটা লিখতে বসলাম—
“শক্তিশালী স্বাধীন নারীতে আকৃষ্ট হবার অসুবিধাটা হলো, আপনাকে (পুরুষকে) তাদের দরকারই নাই”
এটা কেন ফালতু কথা সেটা আর নতুন করে নাইবা বললাম। পৃথিবীতে কেউ না কেউ আছে যে আপনাকে বেটার পার্সন হতে সাহায্য করে। কারণ ভালোর তো কোনো শেষ নাই। শেষ নাই স্বাধীন বা শক্তিশালী হবারও।
পারমিতা হিম
২২ মে,২০২১